মিরপুরের বিশাল দশটি বধ্যভূমি দখলমুক্ত করে দ্রুত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে নির্মূল কমিটির আহ্বান
- আপডেট সময় : ০৩:৫৮:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১ ২৮৮ বার পড়া হয়েছে
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯০ হাজারের বেশি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। তারপরও কিছু পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ না করে অবস্থান নিয়েছিল মিরপুরের অবাঙালি রাজাকার আলবদর অধ্যুষিত এলাকায়। দেড় মাস তারা তাদের এই অবস্থান ধরে রেখেছিল। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী হানাদার মুক্ত করতে মিরপুরে অভিযান চালায়। নিখোঁজ অগ্রজ সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে মিরপুর এসে বরেণ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা ও কথাশিল্পী জহির রায়হান এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছেন। মিরপুর মুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা লে. সেলিম ও পুলিশের ডিএসপি লোধীসহ সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। যাঁদের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গনে আমাদের বিজয় ঘটে ১৯৭২-এর ৩১ জানুয়ারি।
মিরপুরের যুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও ৩১ জানুয়ারি ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ ‘মিরপুর মুক্ত দিবস’ পালন করে। করোনা মহামারীর কারণে এ বছর মিরপুরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে জনসমাবেশ ও র্যালীর না করে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
মিরপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হন শিল্প প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদ মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন মিরপুর রণাঙ্গনের অন্যতম অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হারুণ হাবীব, বিশিষ্ট চলচ্চিত্রনির্মাতা নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ, ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গণ মিরপুর : জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ’ গ্রন্থের লেখক সাংবাদিক জুলফিকার আলি মাণিক, মিরপুরে শহীদ চলচ্চিত্রনির্মাতা ও কথাশিল্পী জহির রায়হানের পুত্র অনল রায়হান, মিরপুরে শহীদ সাংবাদিক আবু তালেবের পুত্র খন্দকার আবুল আহসান, আমরা নতুন প্রজন্ম-এর আহ্বায়ক এডভোকেট মনিরুল ইসলাম কিরণ ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল।
সভাপতির প্রারম্ভিক ভাষণে শাহরিয়ার কবির ১৯৭২-এর ৩১ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর মুক্ত করতে গিয়ে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ৯০ হাজারেরও বেশি সদস্য আত্মসমর্পণ করলেও এদের কয়েকজন এবং মিরপুরের ঘাতক রাজাকার, আলবদররা আত্মসমর্পণ করেনি। জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক আলবদর বাহিনীর সদস্যরা কোথাও আত্মসমর্পণ করেনি। জনরোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা বিষধর সাপের মতো গর্তে লুকিয়ে ছিল। গোপনে তারা পাকিস্তানের হয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের অন্তর্ঘাত চালিয়েছে এবং বিভিন্ন দলে অনুপ্রবেশ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এখনও ’৭১-এর ঘাতক দালাল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এবং তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক উত্তরসূরীরা সরকারি দলসহ বিভিন্ন দলে এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছে। যাদের দ্রুত চিহ্নিত করে অপসারণ না করলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে।
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘নির্মূল কমিটি দীর্ঘকাল যাবৎ মিরপুরের বিশাল বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছে। এসব বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের অবাঙালি দোসরদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ’৭২- জাতীয় গণমাধ্যমসমূহে প্রকাশিত হয়েছে। মিরপুরের অধিকাংশ বধ্যভূমি বেদখল হয়ে গিয়েছে। এগুলো দখলমুক্ত করে জল্লাদখানা বধ্যভূমির মতো সংরক্ষণ করার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।’
শিল্প প্রতিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, যেহেতু মিরপুর একটি বিহারী এলাকা ছিল-এখানে প্রধানত বিহারীরা বসবাস করত। এরা বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার করত, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের আশ্রয় দিত। এদের অত্যাচারে অনেক বাঙালি বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়, অনেককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরÑ আলবদর বাহিনীর অনেক সদস্য এখানে আত্মগোপন করেছিল। এরাই বুদ্দিজীবীদের ধরে এনে এখানে এবং অন্যত্র নিমর্মভাবে হত্যা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র মিরপুরকেই তারা জল্লাদখানায় পরিণত করেছিল। মিরপুরে অনেক বছর পরেও বাড়িঘর, মসজিদ নির্মাণ করতে গিয়ে শহীদের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। মিরপুরকে এক খণ্ড পাকিস্তানে পরিণত করে রেখেছিল ঘাতকরা।
এখনও মিরপুরকে অনেকে মিনি পাকিস্তান বলে থাকে। এই অপবাদ আমাদের ঘোচাতে হবে। মিরপুরের নাম পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধ নগর বা এ ধরনের কিছু আমরা করতে পারি কিনা, সেটি ভেবে দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩১ জানুয়ারি ১৪০ জন সেনা সদস্য এবং তিন শতাধিক পুলিশ বাহিনীর সদস্য মিরপুর এসে মিরপুর মুক্ত করার যুদ্ধে লিপ্ত হন। শতাধিক সেনাসদস্য এবং পুলিশ সদস্য মিরপুর যুদ্ধে নিহত হন। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানও এই যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি অনেক বড় এবং মর্মান্তিক একটি যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ইতিহাস বিশেষভাবে সংরক্ষিত হওয়া দরকার, আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। নিহতদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হওয়া দরকার। আমি মনে করি- মিরপুরের নামটি পরিবর্তন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ নগর’ করা যেতে পারে-এ বিষয়ে আমি নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে অনুরোধ করব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। আমি নিজেও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করব। এদিন ১০ টায় জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে মিরপুরের শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি আরম্ভ হয়।