বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা: পাকিস্তানের বিচার চাইলেন শহীদ কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী
- আপডেট সময় : ০৩:৫২:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২১ ৩০৫ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস ডিজিটাল ডেস্ক
ভারতের রাজধানী দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কানায় কনায় ভর্তি। ‘জম্মু ও কাশ্মির ইউনিটি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন আয়োজন করেছিল এই আলোচনাসভার। সেখানে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময়ে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের হাতে শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী। ভরা আলোচনা সভায় তাদের কণ্ঠে পরিষ্কার উচ্চারণ ‘পাকিস্তান
একটি গণহত্যাকারী দেশ’। নুজহাত পাকিস্তানের বিচার চাইলেন। যেখানে উপস্থিত ছিলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টোরিয়ান বব ব্ল্যাকম্যান, ফরাসি লেখক ফ্রাসোয়াঁ গঁতিয়ে, কাশ্মিরি অ্যাকটিভিস্ট অজয় চরুঙ্গু, ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক নীতিন গোখলে, বালোচিস্তান গবেষক সন্ধ্যা জৈন প্রমুখ। এসব বোদ্ধাসহ একবাক্যে গোটা সভা থেকেই পাকিস্তানকে একটি ‘জেনোসাইডাল নেশন’ বা গণহত্যাকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বাংলাদেশের শহীদ-বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর কন্যা ড. নুজহাত চৌধুরী উক্ত দাবি তোলেন। আন্তর্জাতিক হলোকস্ট স্মরণ দিবসে তার সেই দাবিতে গলা মেলালেন দেশ-বিদেশের নামী প্যানেলিস্টরা। গণহত্যার বিচার ও প্রতিকারের দাবিতে একটি ‘আন্তর্জাতিক জোট’ গঠনেরও আওয়াজ উঠে সেখানে।
বাংলাদেশ থেকে শুরু করে বালোচ, শিয়া হাজারা, কাশ্মিরি পন্ডিত বা আফগানদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনার মদতে দশকের পর দশক ধরে যেভাবে নির্বিচার গণহত্যা চালানো হয়েছে সে জন্যই এই অভিধায় পাকিস্তানকে বর্ণনা করেন তারা।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণে সম্ভবত সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি ড. নুজহাত চৌধুরী। যিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে একাত্তরের গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষ ভিকটিম। যার শৈশব ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের ঠিক আগের দিন তার পিতা ঢাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক আলীম চৌধুরীকে রাজাকাররা কীভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, অশ্রুসজল কণ্ঠে সে কাহিনী বর্ণনা করেন তিনি।
ড. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তানিদের সেই গণহত্যাকে ভুলিয়ে দেওয়ার হাজারো চেষ্টা হয়েছে, আজও হচ্ছে। পাকিস্তান বলেছে যা হয়েছে তা হয়ে গেছে, এখন আমরা দুই দেশই মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বোধে এগিয়ে যাই। কিন্তু তারা একবারের জন্যও ক্ষমা চায়নি, সেই গণহত্যার জন্য একজন পাকিস্তানি জেনারেলেরও বিচার হয়নি। যে কোনও আঘাতেরই তো একটা ‘ক্লোসার’ দরকার। একজন চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, ঠিকমতো নিরাময় না-হলে ক্ষতস্থানের ব্যথা কিন্তু রয়েই যায়। আর এখানে তো আমরা দেখি, গণহত্যার ত্রিশ লাখ ভিকটিমের সংখ্যাটাও কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা হতে থাকে অবিরত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই যে বাংলাদেশে অবশেষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, তাদের অনেকের ফাঁসি পর্যন্ত হয়েছে এবং বিএনপি-জামাত শাসনামলে তা স্বপ্নেও ভাবা যেত না সে কথাও মনে করিয়ে দেন নুজহাত। তবে আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, গণহত্যার যারা মূল কারিগর ছিল সেই পাকিস্তানিরা আজও বিচারের বাইরে। বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানিদের বিচার হয়নি বলেই তারা আজ বালোচিস্তানে একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। মন্তব্য করেন নুজহাত চৌধুরী।
সভায় এর আগে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্তরে বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি ‘জেনোসাইড অ্যাকট’-এরও দাবি জানান যুক্তরাজ্যের এমপি বব ব্ল্যাকম্যান। তার বক্তব্য ছিল, এই ধরনের আইন হলেই কেবল গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের বিচার নিশ্চিত করা যাবে। কাশ্মিরি পন্ডিত সমাজের প্রতিনিধি ও লেখক ড. অজয় চ্রুঙ্গু জানান, কীভাবে পাকিস্তানি মদতপুষ্ট জঙ্গিরা লক্ষ লক্ষ পন্ডিতকে শ্রীনগর ভ্যালি থেকে রাতারাতি এক কাপড়ে বিদায় নিতে বাধ্য করেছিল এবং পন্ডিত সমাজের অসংখ্য নারী কীভাবে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
অনুসন্ধানী গ্রন্থ ‘কে ফাইলসে’র লেখক ও কাশ্মিরি গবেষক বশির আসাদ জানান, বছর দেড়েক আগে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরের দু’মাসে অন্তত ৪৮ জন নিরীহ কাশ্মিরি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে মারা গেছেন। যাদের কেউ ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী, কেউ আপেল চাষী বা কেউ গরিব গ্রামবাসী। এদের হত্যার পেছনেও পাকিস্তানের হাত ছিল বলে তিনি দাবি করেন।
ড. নুজহাত চৌধুরী তার বক্তৃতায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণহত্যাকারীদের দয়া করে ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে বিচার করবেন না। তারা মুসলিম, হিন্দু বা বৌদ্ধ নয়-তারা খুনি ‘পাকিস্তানের মুসলিম সেনারাই আমার মুসলিম পিতাকে হত্যা করেছে। আবার মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে বৌদ্ধরা। সুতরাং গণহত্যাকারীর কোনও ধর্ম হয় না, এটাই সার কথা’, বব ব্ল্যাকম্যানের অনুরূপ বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেন তিনি।
আয়োজক সংস্থা জম্মু ও কাশ্মির ইউনিটি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অজাত জামওয়াল মনে করিয়ে দেন, ‘আন্তর্জাতিক হলোকস্ট স্মরণ দিবস পালন করা হয় গণহত্যায় নিহত ষাট লক্ষ ইহুদি ও আর্মেনিয়কে স্মরণ করতে। কিন্তু বাংলাদেশ, বালোচিস্তান বা কাশ্মিরে যা ঘটেছে জাতিসংঘ আজও তাকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেয়নি সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।’
গণহত্যার অভিযোগে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিচারের দাবিতে একটি গ্লোবাল অ্যালায়েন্স বা বিশ্বজোট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন বক্তারা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সে দেশে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বলেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তান যা করেছে তা বাংলাদেশ কখনও ভুলতেও পারবে না এবং পাকিস্তানকে ক্ষমাও করতে পারবে না। এরপরই ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়, তা হলে ভারত সর্বতোভাবে সেই দাবিকে সমর্থন জানাবে।