ঢাকা ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পহেলা বৈশাখই সম্রাট আকবরের পুন্যাহ বা হালখাতা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:২৪:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১ ২৮০ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, মালদা

বাঙালির নববর্ষ, বাঙালির এক জাতীয় আবেগের উৎসব। এদিন দোকানে দোকানে পুজোপাঠ ইত্যাদির মধ্যেই বাঙালি নতুন করে বছর শুরু করে। দুই বাংলাতেই চিরন্তন বাঙালির সর্বস্ব আবেগ দিয়ে বর্ষবন্দনা করে, যা এখন রীতি বা রেওয়াজে পরিনত হয়ে গেছে। কিন্তু ১লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ মানেই যে হালখাতা, তা নিয়ে যথেষ্টই প্রশ্ন থেকে যায়।

সেইসব প্রশ্নোত্তরে যাওয়ার আগে হাল-এই শব্দটিকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া জরুরি। সংস্কৃত ও ফারসি শব্দ হাল- বাংলায় একটি অনুপ্রবেশকারি শব্দ। কিন্তু হাল বলতেই বাঙালির চোখে ভেসে ওঠে কৃষিজমিতে হাল-লাঙল সমেত একজোড়া বলদের ছবি। সেই হালকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে কৃষিজীবী বাঙালির আদিকালে কর্ষিত দ্রব্যের বিনিময় প্রথা এসে যায়। ধরা যাক, যে ব্যক্তি ধান চাষ করেন, তিনি লবন তৈরির কেরামতি জানেননা। স্বভাবতই তাকে সেই কারিগরের কাছে হাত পাততেই হবে, যিনি লবন তৈরির কেরামতি জানেন।

উল্টোদিকে ধানচাষির কাছেও লবনের কারিগরকে হাত পাততেই হবে। সুতরাং দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে যেদিন থেকে পারস্পরিক আদান-প্রদান শুরু হোলো, সেদিন থেকেই দেনাপাওনা, দেনাদার-পাওনাদার শব্দসম্ভার বাংলা অভিধানে তার নিজস্বী তৈরি করে নিলো। ধরে নেওয়া যায়, লিপি আবিস্কারের যুগের সেই বিপ্লবকালে মানুষ যখন থেকে তার উৎপাদিত দ্রব্যসমুহকে বিক্রয় নিমিত্তে বা বিনিময়ের প্রাসঙ্গিকতায় লিখে রাখতে শুরু করেছিলেন, বাঙালির ঘরে সেদিন থেকেই লাল শালুতে মোড়া শস্তিক চিহ্নিত একটি খাতা ব্যবসায়িক শ্রীমণ্ডিত হয়ে প্রবেশ করেছে।

যেহেতু ১লা বৈশাখের পুণ্য লগ্নে পুরাতনী বিদায়ের সাথে সাথে পুরাতন হিসাবেরও বিদায় ঘন্টা বাজে, তাই, ১লা বৈশাখের বিশেষ দিনে সেই লালখাতাটিও যথেষ্ট তাৎপর্যপুর্ণ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হোলো, ১লা বৈশাখ বা বাংলা বছর শুরুর এই দিনটি কবে থেকে হালখাতায় পরিনত হয়েছে। আনুমানিক পাঁজি আবিস্কারের ৩১৯ খৃষ্টাব্দই ১লা বৈশাখের নববর্ষ, এটা ধরে নেওয়া হয়।

যেহেতু পাঁজি’র সাথে বাঙালির সামাজিক আচার-আচরণবিধি অনেকটাই সম্পর্কিত, তাই ধরে নেওয়া হয়, ওই সময় থেকেই নববর্ষ ও হালখাতা সমার্থক হয়ে গেছে। বাংলায় মোঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবকে নিয়ে যদি একটু নাড়াচাড়া করা যায়, তবে সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের নিমিত্তে পুন্যাহ বলে একটি বিশেষ দিন চালু করেছিলেন, যেদিন জমিদারেরা তাদের সংগৃহিত কর সম্রাটের কোষাগারে রাজস্ব হিসেবে দিয়ে যেতেন।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁএর সময়ও এই পুন্যাহএর ইতিহাস পাওয়া যায়, যা কিনা খাতা নির্ভর জৈবিক-বৈচিত্রে ভরপুর এক বিশেষ আয়োজন। তবে যাই হউক না কেনো,জোড়া বলদএর কাঁধে চাপানো লাঙলের ফলার ওপরের ‘হাল’ যে, নববর্ষের নতুন খোলা শ্রীমণ্ডিত একটি হিসেবের জৈবিক খাতা, তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

 লেখক : শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, কবি, সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক, বসবাস পশ্চিমবঙ্গের মালদায় 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published.

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

পহেলা বৈশাখই সম্রাট আকবরের পুন্যাহ বা হালখাতা

আপডেট সময় : ০৯:২৪:০১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ এপ্রিল ২০২১

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, মালদা

বাঙালির নববর্ষ, বাঙালির এক জাতীয় আবেগের উৎসব। এদিন দোকানে দোকানে পুজোপাঠ ইত্যাদির মধ্যেই বাঙালি নতুন করে বছর শুরু করে। দুই বাংলাতেই চিরন্তন বাঙালির সর্বস্ব আবেগ দিয়ে বর্ষবন্দনা করে, যা এখন রীতি বা রেওয়াজে পরিনত হয়ে গেছে। কিন্তু ১লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ মানেই যে হালখাতা, তা নিয়ে যথেষ্টই প্রশ্ন থেকে যায়।

সেইসব প্রশ্নোত্তরে যাওয়ার আগে হাল-এই শব্দটিকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া জরুরি। সংস্কৃত ও ফারসি শব্দ হাল- বাংলায় একটি অনুপ্রবেশকারি শব্দ। কিন্তু হাল বলতেই বাঙালির চোখে ভেসে ওঠে কৃষিজমিতে হাল-লাঙল সমেত একজোড়া বলদের ছবি। সেই হালকে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে কৃষিজীবী বাঙালির আদিকালে কর্ষিত দ্রব্যের বিনিময় প্রথা এসে যায়। ধরা যাক, যে ব্যক্তি ধান চাষ করেন, তিনি লবন তৈরির কেরামতি জানেননা। স্বভাবতই তাকে সেই কারিগরের কাছে হাত পাততেই হবে, যিনি লবন তৈরির কেরামতি জানেন।

উল্টোদিকে ধানচাষির কাছেও লবনের কারিগরকে হাত পাততেই হবে। সুতরাং দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে যেদিন থেকে পারস্পরিক আদান-প্রদান শুরু হোলো, সেদিন থেকেই দেনাপাওনা, দেনাদার-পাওনাদার শব্দসম্ভার বাংলা অভিধানে তার নিজস্বী তৈরি করে নিলো। ধরে নেওয়া যায়, লিপি আবিস্কারের যুগের সেই বিপ্লবকালে মানুষ যখন থেকে তার উৎপাদিত দ্রব্যসমুহকে বিক্রয় নিমিত্তে বা বিনিময়ের প্রাসঙ্গিকতায় লিখে রাখতে শুরু করেছিলেন, বাঙালির ঘরে সেদিন থেকেই লাল শালুতে মোড়া শস্তিক চিহ্নিত একটি খাতা ব্যবসায়িক শ্রীমণ্ডিত হয়ে প্রবেশ করেছে।

যেহেতু ১লা বৈশাখের পুণ্য লগ্নে পুরাতনী বিদায়ের সাথে সাথে পুরাতন হিসাবেরও বিদায় ঘন্টা বাজে, তাই, ১লা বৈশাখের বিশেষ দিনে সেই লালখাতাটিও যথেষ্ট তাৎপর্যপুর্ণ হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হোলো, ১লা বৈশাখ বা বাংলা বছর শুরুর এই দিনটি কবে থেকে হালখাতায় পরিনত হয়েছে। আনুমানিক পাঁজি আবিস্কারের ৩১৯ খৃষ্টাব্দই ১লা বৈশাখের নববর্ষ, এটা ধরে নেওয়া হয়।

যেহেতু পাঁজি’র সাথে বাঙালির সামাজিক আচার-আচরণবিধি অনেকটাই সম্পর্কিত, তাই ধরে নেওয়া হয়, ওই সময় থেকেই নববর্ষ ও হালখাতা সমার্থক হয়ে গেছে। বাংলায় মোঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবকে নিয়ে যদি একটু নাড়াচাড়া করা যায়, তবে সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের নিমিত্তে পুন্যাহ বলে একটি বিশেষ দিন চালু করেছিলেন, যেদিন জমিদারেরা তাদের সংগৃহিত কর সম্রাটের কোষাগারে রাজস্ব হিসেবে দিয়ে যেতেন।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁএর সময়ও এই পুন্যাহএর ইতিহাস পাওয়া যায়, যা কিনা খাতা নির্ভর জৈবিক-বৈচিত্রে ভরপুর এক বিশেষ আয়োজন। তবে যাই হউক না কেনো,জোড়া বলদএর কাঁধে চাপানো লাঙলের ফলার ওপরের ‘হাল’ যে, নববর্ষের নতুন খোলা শ্রীমণ্ডিত একটি হিসেবের জৈবিক খাতা, তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

 লেখক : শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, কবি, সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক, বসবাস পশ্চিমবঙ্গের মালদায়