‘পনেরো মাসের লড়াইয়ের চিত্র গোটা দুনিয়ায় অভিন্ন’

- আপডেট সময় : ১১:১৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ জুলাই ২০২১ ১৬৯ বার পড়া হয়েছে
ফাইল ছবি
লাগামহীন করোনা সংক্রমণ: সরকারী-বেসরকারি হাসপাতাল চিত্র
`ডেল্টা প্লাসকে অত্যন্ত সংক্রামক বলে মনে করা হচ্ছে। ডেল্টা প্লাস মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ককটেল চিকিৎসায় প্রতিরোধ সম্ভব। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সতর্ক করেছেন, ডেল্টা প্লাস করোনার তৃতীয় ঢেউ হিসেবে আছড়ে পড়বে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করতে পারে’
চারিদিকে পিলে চমকানো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটোছুটি। পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের গতি স্তব্ধ হবারই কথা। তারপরও প্রয়োজন কোন যুক্তি মানেনা। মানুষকে চলতেই হয়। ঘরে ঘরে অজাহারির প্রায় পনেরো মাস অতিক্রম হয়েছে। কিন্তু করোনার থামার কোন রহ্মণ দেখা যাচ্ছে না।
কোন দেশে সংক্রমণ নিম্নগতি তো ফের কিছুদিনের মাথায় ফণা তুলে ওঠে করোনার নয়া ভ্যারিয়েন্ট! এই ওঠা-নামাকে সঙ্গীকে করেই গোটা দুনিয়ার মানুষকে লড়াইটা চালাতে হচ্ছে।

অর্থনীতি, খাদ্য, কর্মহীন, দরিদ্রতা, শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার চিত্রটা কোন একক দেশের চিত্র নয়, এটা গোটা দুনিয়ার চিত্র। নিকট অতীতে এরকম মহামারি দেখেনি মানুষ। এটি বৈশ্বিক মহামারির মর্যাদা পেয়েছে।
বছর দেড়েক ধরে নানা প্রজাতির করোনার ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানিরা। এর মধ্যে ডেল্টা ধরণের ভাইরাসটিরই এখন রাজত্ব চলছে। এটি অতিদ্রুত ছড়ায় এবং কঠিন সংক্রমণ ঘটিয়ে চলে। ফুসফুসে আক্রমণ ডেল্টার একটি বিশেষ স্থান। বাংলাদেশের বিজ্ঞানিরা গবেষণায় দেখেছেন, আক্রান্ত্রের ৮০ শতাংশই ডেল্টা ধরণ। যা ভাবিয়ে তুলছে।
সর্বশেষ ভারতে ডেল্ট প্রজাতি ধরা পড়েছে। এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে অনেকে। এই ডেল্টাপ্লাস নিয়ে গোটা দুনিয়া চিন্তিত! এই প্রজাতিকে ‘ভ্যারিয়্যান্ট অব কনসার্ন’এর আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর ভারত সরকার এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ আখ্যা দিয়েছে। সহজ ভাষায় এর অর্থ, এতদিন এই প্রজাতি নিয়ে বিশেষ আশঙ্কা না থাকলেও এবার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেল্টা থেকেই ভাইরাসটি রূপ বদলে তৈরি হয়েছে ডেল্টা প্লাস।
বাংলাদেশ চিত্র
বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গিয়েছে ১ জুলাই দিন। এদিন করোনা আক্রান্ত ১৪৩জনের মৃত্যু দেখেছে দেশটি। ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনায় তিন ব্যক্তি আক্রান্তর খবর পাওয়া যায়। তারপর দ্রুত অর্থাৎ দশদিনের মাথায় এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
করোনা নামক ভাইরাসটি চিকিৎসা বিজ্ঞানিদের কাছে একেবারেই নতুন। এমন পরিস্থিতে করণীয় বিষয় নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপর পনেরো মাসের ইতিহাস ভাইরাস সংক্রান্ত নানা তথ্যে ঠাসা। কোন ভাইরাসের এতোটা দ্রুত প্রতিষেধক অবিষ্কারেরও ইতিহাস নেই। মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে করোনার প্রতিরোধী কায়দা।
কিন্তু না মানার সংস্কৃতিকে তাড়াবেন কি করে?
ভাইরাসটি দুনিয়কে নতুন ভাবে বাচার লড়াই করতে শেখালো। আবিষ্কৃত হলো লকডাউন তথা মানুষের চলাচল বন্ধ রেখে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রন। কেন? করোনা ভাইরাসটির চরিত্র হচ্ছে, সে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আর দেহে প্রবেশের স্থান হচ্ছে-মুখ-নাক এবং চোখ। তাই লকডাউন দিয়ে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই বিষয়টি দুনিয়া নতুন করে শিখে নিল। কিন্তুনা মানার সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা মানুষ এটা মানতে চায় না। অবশেষে অবাদ চলাচল থামাতে কঠোর হতে হয়েছে প্রশাশনকে।
আক্রান্ত ও হাসপাতাল চিত্র
দুনিয়া জুড়েই প্রাইভেট অর্থাৎ ব্যক্তিগত প্রথার সঙ্গে মানুষ পরিচিত। এই ব্যবস্থায় সকল ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বাণিজ্যি পরিষেবার মতো হাসপাতাল, জলের সরবরাহ, বিদ্যুৎ, উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে বৃহৎ আকারের শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট, উড়াল সেতু ইত্যাদি কর্মকান্ড পরিচালনা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।
তবে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে বিভিন্ন দেশেই বাণিজ্যিক পরিধি যে বেড়ে চলেছে, তা কিন্তু আধুনিক জমানাই স্বাক্ষী। কারণ, বিজ্ঞানের অগ্রগতির বদৌলতে কত রকমের রোগের সঙ্গে মানুষ পরিচিত এবং উপকৃত হচ্ছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। অধিকাংশ চিকিৎসার জন্যই ব্যক্তি হাসপাতালে মানুষকে ছুটে যেতে হচ্ছে।
করোনা তান্ডবে হাসপাতাল পরিস্থিতি
করোনার ব্যাপকতায় হাসপাতাল তথা সেবালয়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নেই বললেই চলে। করোনাকে সামাল দিতে চিকিৎসক জীবন বাজি কাজ করে চলেছেন। সেবা দিতে গিয়ে বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি দেশের মানুষই তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানিয়েছে।
কিন্তু ঊর্ধমুখি সংক্রমনের কারণে দিশেহারা স্বাস্থ্য বিভাগ। এটাতো কোন একক দেশের চিত্র নয়। সমানভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই চিত্র। এখানে আশঙ্কাজনক সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। একারণে সাতদিনের কঠোর লকডাউন চলছে।
এ অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। বেসরকারি হাসপাতালে কোন বিছানা খালি নেই। উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও রোগী ভর্তি। আক্রান্তের প্রায় ৯০ শতাংশই বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। জটিল হলে হাসপাতাল মুখো হচ্ছেন। কিন্তু পরিস্থিতি কঠিন হচ্ছে।
এই অবস্থায় বাণিজ্য নগরীর ‘চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) এক গবেষণায় ওঠে এসেছে যারা এখনও পর্যন্ত করোনার টিকা না নিতে পারেননি, তারাই বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
যা বলেন হাসপাতাল পরিচালক
চিকিৎসকরা জানান, শ্বাসকষ্ট ও কাশি যখন সামাল দিতে পারে না, তখনই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। একারণে অধিকাংশ রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আক্রান্তদের অল্প সময়ের মধ্যে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এখানের ৩০০ শয্যার অর্ধেক খালি রয়েছে।
‘ডেল্টা প্লাস’ কেন উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব?
ভারতের ডেল্টা প্রজাতি (বি.১.৬১৭.২) নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা দুনিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই ডেল্টা প্রজাতিকে এই মুহূর্তের সবচেয়ে মারাত্মক প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডেল্টা থেকেই ভাইরাস রূপ বদলে তৈরি হয়েছে ডেল্টা প্লাস। ভারতের যে তিন রাজ্যে ডেল্টা প্রজাতির প্রমাণ মিলেছে, সেখানে সরকার নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
ডেল্টা প্লাস দ্রুত ফুসফুস আক্রমণ করতে পারে
ভারতের বিজ্ঞানিরা জানিয়েছেন, ডেল্টা প্লাস অনেক বেশি সংক্রামক ঘটাতে পারে। দ্রুত বেশি সংখ্যায় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে গবেষণায়। ডেল্টা প্লাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে আরও দ্রুত ফুসফুস আক্রমণ করতে পারে বলেও জানা গিয়েছে। যে কোষগুলো ফুসফুসের চারপাশে ঘিরে রয়েছে, তার বাঁধুনি আরও দ্রুত ভেঙে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানিরা।
৯টি দেশে মিলেছে ডেল্টা প্লাস
জাপান, সুইৎজারল্যান্ড, ব্রিটেন, আমেরিকাসহ ৯টি দেশে ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে ডেল্টা প্লাসের প্রমাণ। এখনও পর্যন্ত বাজারে যে কোভিড প্রতিষেধকগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো এই প্রজাতির ওপর কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহু বিজ্ঞানী। তবে গবেষণা এখনও চলছে, তাই কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি।
মোনোক্লানাল অ্যান্টিবডি ককটেল খুব একটা কার্যকরী নয় এই নতুন প্রজাতির ক্ষেত্রে। তাই ডেল্টা প্লাসে আক্রান্ত হলে শরীরে বেশি মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ভারতে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা
যেসব রাজ্যে ডেল্টাপ্লাস দেখা দিয়েছে, সেখানে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা, ছোট ছোট এলাকায় মানুষের মেলামেশা সীমিত রাখা এবং বিপুল পরিমাণে কোভিড পরীক্ষা করানোর উপদেশ নেওয়া হয়েছে। নতুন প্রজাতি যাতে কোনওভাবেই বেশি সংখ্যায় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়তে পারে, তার সব রকম ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে।