দীর্ঘ সীমান্ত, অসীম সংগ্রাম
- আপডেট সময় : ১২:১২:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মার্চ ২০২১ ২৯৭ বার পড়া হয়েছে
“বাংলাদেশ ও ভারত পাজরে পাজর মিশিয়ে থাকা দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ। বিশ্বে এই সুদৃঢ় বন্ধন উজ্জ্বল। দুই দেশের সীমান্ত জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির হাতছানি, নদী-নালা। জলে ভাসা নানা দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য। চোখে পড়ে বাড়িঘর, গৃহপালিত পশু-পাখি এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়ানোর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এমন পরিস্থিতি দু’দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলে দেয় “হাত বাড়ালেই বন্ধু, পা বাড়ালেই পথ”
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম সীমান্ত যা ইঙ্গিত দেয় সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার। এখানে রয়েছে, দুই সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী তথা বিজিবি এবং বিএসএফ। তারাই সীমান্তের শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করে থাকেন। তবে, বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে জটিল সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। এই সীমানা অবারিত এবং অনেকটা বিপজ্জনকভাবেই। উভয় দেশের মধ্যে ৪০৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা নদী ও জলাভূমি থেকে শুরু করে কৃষিজমি এবং কিছু জায়গায় মানুষের বসতবাড়ির মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে সীমান্তের সুরক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব সীমান্তের কেবলমাত্র একটি অংশ কাঁটাতারের বেড়াযুক্ত রাখা হয়েছে।
মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডকে পৃথককারী মূল সীমান্ত-জিরো পয়েন্টের পরিবর্তে প্রকৃত সীমানা হিসেবে বেড়াগুলোকে ভুল বোঝে। তাছাড়া, উভয় দেশের সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত মিল সীমান্ত কর্মীদের জন্য একটি অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ। গত তিন বছরের খতিয়ান অনুযায়ী এ সময়টাতে দেড় হাজারের বেশি সীমানা বেড়া অতিক্রমের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে।
রাতের গাঢ় অন্ধকারে চোরাকারবারী এবং অপরাধীরা অবৈধভাবে প্রতিবেশী দেশের সীমানায় প্রবেশ করে। এ জাতীয় সব ঘটনা মধ্যরাতের পরে ঘটে। ফলে, সমস্ত সীমান্ত হত্যা সংঘটিত হয়েছে রাত ১২টা থেকে ভোর চারটার মধ্যে। কখনও কখনও সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে এবং নিরাপত্তা কর্মীরাও আহত হয়ে থাকেন।
গত এক দশকে, সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৭ জন বিএসএফ সদস্য শহীদ এবং ১১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। জিরো লাইনের দেড়শ’ গজ ছাড়িয়ে এ জাতীয় বেশিরভাগ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীদের কখনও কখনও অন্য দেশের সীমানার এক থেকে চার কিলোমিটার অভ্যন্তরে দেখা গেছে, যা মানুষের ঘরবাড়ি এবং জীবিকার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সীমান্ত হত্যাকে যথাযথভাবে বললে ‘সীমান্তের ভিতরে হত্যা’ বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় সরকারই সীমান্তে টহল সক্ষমতা জোরদার করছে। প্রকৃতপক্ষেই বিএসএফ এবং বিজিবি উভয় বাহিনীরই উন্নত আইন প্রয়োগের কারণে সীমান্তে মানব পাচার, চোরাচালান ও অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের ঘটনা প্রতিটি সূচকেই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন ধরণের ভূখণ্ডের কারণে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও, পূর্বে প্রচলিত জনপ্রিয় ক্রসিং পয়েন্টগুলি অনস্বীকার্য উন্নতি করেছে।
সীমান্তে অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ হ্রাস পেয়ে মাদকের চালান আটক, জনবল এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সমস্যার মাত্রা সুদূরপ্রসারী। উদাহরণস্বরূপ, ইউএস-মেক্সিকো সীমান্তে উঁচু দেয়াল, উন্নততর প্রযুক্তি, ড্রোন এবং ওভারহেড হেলিকপ্টার থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
সব সময় এমন কয়েকটি অঞ্চল থাকবে যেখানে বেড়া দেওয়া অসম্ভব এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা কঠিন। সীমান্ত টহলকর্মীরা বলেছেন, তারা তাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও ভারত ইতোমধ্যেই একটি অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র নীতি অনুসরণ করে। বিএসএফ এবং বিজিবির দ্বারা গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি ও যৌথ টহল আগের চেয়ে অনেকটা উন্নত হয়েছে।
সম্প্রতি, সকল নিরস্ত্র ও নিরীহ সীমান্ত অতিক্রমকারীদের বিজিবির হাতে তুলে দিয়েছে বিএসএফ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ ধরনের ৬০ জন নিরাপদে দেশে ফিরে এসেছেন। জীবিকা নির্বাহ, ব্যবসা এবং দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের জন্য প্রতিদিন অনেক মানুষ আইনসঙ্গতভাবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতে পর্যটকদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশী যারা স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ কেবলমাত্র এই মানুষে-মানুষে যোগাযোগকে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
প্রশ্ন থেকেই যায়, একটি সুরক্ষিত সীমানা বলতে কী বোঝায়? ১১১টি সীমান্ত জেলায় বসবাসকারী কয়েক মিলিয়ন মানুষের জন্য এর মানে হলো নিরাপদ আশ্রয় এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যা সীমান্তরক্ষী বাহিনী করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের অব্যাহত অর্থনৈতিক বিকাশ এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমান্তে বসবাসকারী মানুষের জন্য আশার আলো দেখাতে পারে। ভারতীয় হাইকমিশনের সহায়তায় প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।