গণমানুষের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

- আপডেট সময় : ১০:৩৮:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মে ২০২১ ২৭১ বার পড়া হয়েছে
তিনি ছিলেন মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি । অর্থাৎ গণমানুষের কবি সুকান্ত’র অর্থ হচ্ছে, ভাগ্যবান উদার। তিনি মানুষের জন্য কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় মানুষের বেচে থাকার পথের দিশা দেখিয়েছেন। প্রতিটি উচ্চারণে সাহস যুগিয়েছে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের। তার উদারতার পথে হেটেই বঞ্চিত অবহেলিত মানুষ খুঁজে নিয়েছে মুক্তির পথ।
সুকান্ত ভট্রচার্য’র কবিতা বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেওয়াটা ছিল স্বাভাবিক ধারা। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়।
কবির লেখা একটা ‘দেশলাই কাঠি’ কবিতাটিই বলে দেয়-তার জন্মই হয়েছিলো গণমানুষের কবি হিসেবে। তাকে ‘গণনায়ক’ বললেও ভুল হবে না।
‘আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না:
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।’’
মূলত কবির প্রয়ান দিবস, এটা স্মরণেই ছিলো না। কলকাতা থেকে কবির ‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি আবৃত্তি করে দেবাশিষ রায়ের (আমি যাকে কর্তা বলি) ভিডিও পাঠানোর পর নিজের অক্ষমা প্রকাশ পেল।
দেবাশিষ দার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র হচ্ছে, সুস্মিতা দেবি (সুস্মিতা মুখার্জি দাস দত্ত)। তাঁর বাড়িতে এক সন্ধ্যায় মুগ্ধকর আয়োজনে ‘শচিন কর্তা’র গান গেয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন দেবাশিষ দা। তার গায়কী একেবারে শচিন কর্তার মতোই। স্রেই থেকে সুসিম্মতা সব সময় আমার খোজ খবর নিয়ে থাকে। একজন দায়িত্বশীল মানুেষ হিসেবে এক পরম বন্ধুর নাম সুস্মিতা।
পরবর্তীতে সুম্মিতার একটি কথা আমার হৃদমন্দিরে অক্ষত থাকবে চিরদিন। ওর ছোট্ট বার্তায় বলেছিলো, জানো মার্কসবাদ কিন্তু নতুন কোন বিষয় নয়। সেই গৌতম বুদ্ধর জমানা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধও কিন্তু প্রতিবাদ করেই ঘর ছেড়েছিলোন।
হেলে দুলে শচিন কর্তার একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছিলেন দেবাশিষ দা। মাঝে সেলিম দা’র অনুরোধে মান্না দে’র একটা গান করলেন। সেদিন থেকে তাকে কর্তা বলেই ডাকি। সেই দেবাশিষ দা সুকান্তর ছাড়পত্র কবিতাটি আবৃত্তি করে পাঠালেন।
ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥
সুকান্ত ভট্টাচার্যর উল্লেখযোগ্য রচনাবলির ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি।
কবি সুকান্ত হামাগুড়ির বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার আগুন মুখ জন্ম ইতিহাসতো তাই বলছে। বয়স বড়জোর আট কি ন’ বছর। সে থেকেই লেখা শুরু! স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন সুকান্ত। তার দিন কয়েক পর বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পায় ‘বিবেকান্দের জীবনী’।
মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন সুকান্ত। এরপর তার ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। আরও জানা যায়, পাঠশালাতে পড়ার সময়েই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন।

কবি সুকান্তর পিতার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য, মা সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৫ই আগস্ট তিনি তার মাতামহের বাড়ি কলকাতার কালীঘাটের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। এক নিম্নবিত্ত পরিবারে কবির জন্ম। মূলত তার পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত ঊনশিয়া গ্রামে।
বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। মাত্র ২০ বছর বয়স ১৯৪৭ সালের ১৩ মে চির দিনের জন্য হারিয়ে যান কবি।