চিঠি সংগ্রহ লেখক
স্মরণ করছি যাকে,তিনি কাব্য ভূবণের রাজপুত্র কবি শামসুর রাহমান। জন্ম,বাংলাদেশের পুরোনো ঢাকা শহরে।সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।পরাধীন বাংলায় জন্মগ্রহণ করবার জন্য মনে খেদ তো ছিলোই! সেইখান থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর তাঁর লেখা পরপর
দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয় হয়ে যায়। বিংশ শতকের ত্রিশের দশকের পঞ্চ কবির পর, যিনি বাংলা কবিতায় এক নতুন গদ্য রীতির জোয়ারে ভেসেছেন এবং সমগ্র বাঙালিকে ভাসিয়েছেন, তিনি কবি শামসুর রাহমান। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে লেখেন হাতির শুঁড় নামক কবিতা। সে-ই সময় সমকাল নামে একটি পত্রিকায় এই কবিতাটি ছাপা হলে দ্রুত তা পাঠকের মন জয় করে নেয়।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে,তখন কবির ব্যাথিত হৃদয়ের থেকে মোচড় দিয়ে নির্মিত হয় টেলেমেকাস নামে একটি সাংঘাতিক কবিতা। ১৯৬৮ সালের দিকে যখন আইয়ুব খান সব ভাষাভাষীদের জন্য অভিন্ন রোমান হরপ চালু করবার
প্রস্তাব করেন,কবি শামসুর রাহমান গর্জে ওঠেন। ৪১ জন কবি,সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, গল্পকার,সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে এক জোড়ালো বিবৃতি দিয়ে লেখেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা- বর্ণমালা- আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে নিহত যুবক শহীদ আসাদের শার্ট দিয়ে
বানানো পতাকা দেখে মারাত্মক মনোকষ্টে তিনি লেখেন আসাদের শার্ট নামক একটি বিখ্যাত কবিতা।অসংখ্য কবিতা এবং প্রায়ই শতাধিক কাব্যগ্রন্থের স্রষ্ঠা শামসুর রহমান মানুষ হিসেবেও ছিলেন খুবই সংবেদনশীল। বাংলা ভাগ হয়ে গেলেও, তাঁর সমসাময়িক লেখক- কবিদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো অটুট।বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত স্ব-হস্তাক্ষরে লিখিত কিছু চিঠিপত্র এর জ্বাজ্জল্যমান প্রমাণ।
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময়, তিনি পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদির পাড়াতলীর গ্রামের বাড়িতে।এপ্রিলের প্রথম দিকে লেখেন বেদনা ভারাক্রান্ত কবিতা-স্বাধীনতা তুমি’ও তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা। অসাম্প্রদায়িক, প্রেমের রূপায়ণকারী ও প্রকৃতির রস সিঞ্চনকারী এই কবি ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পরাধীনতার অন্ধকার, অন্যায়- অবিচার যতদিন থাকবে, পার্থিব পাঠকের হৃদয়ে চিরন্তনী গান হয়ে বাজবে শামসুর রাহমানএর কবিতা।
‘স্বাধীনতা তুমি’ ও
তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে ‘স্বাধীনতা’’
শামসুর রাহমান
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর,
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস উজার হলো,রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র,
তুমি আসবে ব’লে,ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম,
তুমি আসবে ব’লে,বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর,
তুমি আসবে ব’লে,’হে স্বাধীনতা ‘,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন-তাঁর চোখের নীচে
অপরাহ্নের দূর্বল আলোর ঝিলিক,বাতাসে নড়ছে চুল,স্বাধীনতা তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধরে ঘরের।
স্বাধীনতা তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শুন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে,
তোমার জন্যে,
সগীর আলী,শাহাবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,কেষ্ট দাস,জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা মতলব মিয়া,মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে রুস্তম শেখ,ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ, যার পদভারে একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে—
সবাই অধীর প্রতিক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে জলন্ত ঘোষণার ধ্বনি – প্রতিধ্বনি তুলে,নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে,হে স্বাধীনতা।।