ঢাকা ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আঞ্চলিক আধিপত্যে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে নতুন কৌশল ভারতের

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:১১:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪ ৪০ বার পড়া হয়েছে
ভয়েস একাত্তর অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রভাব যখন নাজুক, তখন নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে নতুন কৌশল নিয়েছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি তুলে ধরছে তারা। প্রতিবেশী দেশগুলোতে তুলনামূলক বিনিয়োগ ও সহায়তা বাড়াচ্ছে। ভারত সরকার এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে অপর দেশকে প্রয়োজনে আর্থিক সহযোগিতা দিতে সক্ষম একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, প্রতিবেশী এই দেশটিকে তখন ৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছিল ভারত। চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ ভুটানের। চলতি বছর ক্ষুদ্র এই দেশটিতে সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে মোদি সরকার। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের সাবেক নেত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থনের জন্য দেশের অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন মোদি। এদিকে, শেখ হাসিনা আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় ভারতের অবস্থান ছিল শক্তিশালী।

এই কৌশলের সর্বশেষ সুবিধাভোগী দেশ মালদ্বীপ। গত বছর দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে ভারতের একটি ছোট সামরিক দল প্রত্যাহার করার দাবিতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা চালিয়েছিলেন দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। তবে সেসব এখন অতীত। এসব ঘটনা ভুলে সোমবার দিল্লিতে একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে গিয়েছিলেন মুইজ্জু। উদ্দেশ্য ছিল, তার সরকারকে চরম আর্থিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলারেও বেশি ভারতীয় সহায়তা নিশ্চিত করা। তাজমহলে স্ত্রীর সঙ্গে একটি ছবিও তোলার সুযোগ হয়েছিল তার।

মোদির পাশে দাঁড়িয়ে মুইজ্জু বলেছিলেন, ‘ভারত মালদ্বীপের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং আমাদের প্রয়োজনে সবসময় মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের মতে, চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী যখন করোনা মহামারির আগের সময়ের অর্থনীতির স্তরে ফিরে যাওয়ার জন্য লড়াই করছে, ভারতের অর্থনীতি তখন প্রায় ৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমলাতন্ত্রের হতাশা সত্ত্বেও ভারতকে বাণিজ্য ও চুক্তির জন্য একটি আকর্ষণীয় অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতারা।

তবে অনেক দরিদ্র ভারতীয়রাই এই প্রবৃদ্ধি থেকে সুবিধা পাওয়ার তেমন কোনও আশা দেখছেন না। কেননা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে দেশটি এখনও হিমশিম খাচ্ছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি সরকারকে কূটনীতির চাকা চালানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ সরবরাহ করছে, যেখানে অর্থনৈতিক সংকট চীনকে তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে অর্থ সহায়তা প্রদানে কিছুটা লাগাম টানতে বাধ্য করেছে।

এই অঞ্চলে বারবার কূটনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও নতুন এই সক্ষমতা ও সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। চীনের আগ্রাসী চাপের মুখে এই অঞ্চলে ঐতিহ্যগত প্রভাব হ্রাস পেয়েছে দেশটির। গত এক বছরে অন্তত তিনটি দেশে ভারতপ্রীতি রয়েছে এমন নেতাদের হয় ভোটে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে, না হয় বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।

একসময়ের ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিরুপমা মেনন রাও বলেছেন, ‘ভারত এখন প্রতিবেশী অঞ্চলে অনেক বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে যে রাজনৈতিক স্বার্থ আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জুড়ে রাখে, আমি মনে করি সেক্ষেত্রে তারা বিশ্বস্ত।’

নিরুপমা বলেছিলেন, এমনকি এই অঞ্চলের নেতারা যারা ‘ঐতিহ্যগতভাবে ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বা গোঁড়া’ তাদের কাছেও দিল্লির সঙ্গে কাজ করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এটি শুধু তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সাহায্য লাভের জন্যই নয় বরং, দীর্ঘমেয়াদে ভারতের সঙ্গে নিজেদের এক সারিতে রাখার জন্য জরুরি। কেননা, তাদের ভয়, ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ভবিষ্যতে তাদের বিপর্যয়কর অবস্থা ফেলতে পারে।

নিরুপমা আরও বলেন, আঞ্চলিক নেতারা ‘ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব ও বিশ্বমঞ্চে ভারত যে অবস্থানে যাচ্ছে তা বোঝার ওপর বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন।’ এদিকে, ভারত কিছু প্রতিবেশীর প্রতি ‘তোষামোদি’ ও ‘কূটনৈতিক চাল’ এড়িয়ে আগের চেয়ে আরও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে।

১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২ হাজার মাইল সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর একটি কঠিন শিক্ষা পেয়েছে ভারত।

ভারতকে আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া রক্ষক হিসেবে দেখা হতো। শেখ হাসিনা যখনই তার সমালোচক ও বিরোধীদের নিপীড়ন করতেন, ভারত তখন তার পশ্চিমা সমালোচকদের চুপ করাতে নিজের কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ওপর জনতার ক্ষোভ ভারতের ওপর ক্ষোভে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল।

আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। সেখানে তার দীর্ঘ উপস্থিতি জনমনে একটি দ্বিধা তৈরি করেছে। একদিকে ভারত তার বন্ধুদের পাশে থাকার ইঙ্গিত দিতে চাইছে। তবে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া দেশটির জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে। কেননা, বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে দেশটি।

মূলত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর পল স্ট্যানিল্যান্ড তার গবেষণায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারতের আস্থা ফিরে পাওয়াকে অতীতের তুলনায় আরও ‘কঠিন’ চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এর জন্য অবশ্য ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

স্ট্যানিল্যান্ডের ভাষায়, ‘ভারতের প্রতিবেশীদের অবশ্যই ভারতের স্বায়ত্তশাসনে কোনও আপত্তি নেই এবং তাদের চীন ও বাইরের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মতো বিকল্প রয়েছে। তবে ভারত এমন একটি বিশাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দেশ, যেটির সঙ্গে সব সরকারকে অন্তত ব্যবসাটা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের কিছু আঞ্চলিক সম্পর্ক এখন ‘দিল্লির সঙ্গে একটি সংযত ও সম্মানজনক অবস্থায়’ রয়েছে। তার এই মন্তব্য যেন নিরুপমার উল্লেখিত একটি বিষয়েরই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে কাজ করার উদ্দীপনা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেতিবাচক জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াও সীমিত করে।’

এরকম সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের বর্তমান সম্পর্ক।

শ্রীলঙ্কায় ২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধের পর দেশটিতে চীনের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। তখন একজন জনতোষণবাদী প্রেসিডেন্টের বিলাসবহুল সব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করেছিল চীন। কলম্বোর কর্মকর্তারা, এমনকি ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও তখন অভিযোগ করেছিলেন যে শ্রীলঙ্কায় দিল্লির উপস্থিতি তখন তুলনামূলক ধীর ও আমলাতান্ত্রিক ছিল।

দুই বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মূলত অব্যবস্থাপনা ও লাগামহীন ব্যয়ের কারণে এই সংকট দেখা দিয়েছিল। এতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চীন কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার ঋণের শর্তাদি পুনরায় আলোচনা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল চীন। আর ভারত তখন এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সহায়তায় ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে হাজির হয়।

ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির এমন পরিবর্তন রাজনৈতিক ফ্রন্টে আরও বেশি দৃশ্যমান ছিল। একবার যখন এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতনের কারণে ভারতের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদসহ দেশটির পুরনো মিত্রদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, মোদি সরকার তখন অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা চালায়।

সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ভারত একটি ছোট বামপন্থি দলের নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকেকে অভ্যর্থনা জানায়। দলটি অতীতে ভারতবিরোধী ছিল। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত তাকেই মনে হয়েছিল। উভয়পক্ষ অতীত পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে আগ্রহী ছিল বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। গত মাসে দিসানায়েকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর কলম্বোতে তাকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেনি ভারত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ছুটে যান ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক।

নিরুপমা বলেছিলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ও সেখানে দেশটির ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংস্থানগুলো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশটিকে ভালোভাবেই এগিয়ে রাখবে।

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক বিষয়ে চীন অনেক ভেবেচিন্তে ব্যয় করছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমি মনে করি, আমাদের প্রতিবেশীরা সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাগুলোতে চীন প্রথম সহযোগী হিসেবে পাশে দাঁড়ায়নি, যেটি করেছে ভারত। আর এটিকে আমি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করি।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

আঞ্চলিক আধিপত্যে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে নতুন কৌশল ভারতের

আপডেট সময় : ১০:১১:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

 

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রভাব যখন নাজুক, তখন নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে নতুন কৌশল নিয়েছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি তুলে ধরছে তারা। প্রতিবেশী দেশগুলোতে তুলনামূলক বিনিয়োগ ও সহায়তা বাড়াচ্ছে। ভারত সরকার এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে অপর দেশকে প্রয়োজনে আর্থিক সহযোগিতা দিতে সক্ষম একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, প্রতিবেশী এই দেশটিকে তখন ৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছিল ভারত। চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ ভুটানের। চলতি বছর ক্ষুদ্র এই দেশটিতে সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে মোদি সরকার। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের সাবেক নেত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থনের জন্য দেশের অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন মোদি। এদিকে, শেখ হাসিনা আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় ভারতের অবস্থান ছিল শক্তিশালী।

এই কৌশলের সর্বশেষ সুবিধাভোগী দেশ মালদ্বীপ। গত বছর দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে ভারতের একটি ছোট সামরিক দল প্রত্যাহার করার দাবিতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা চালিয়েছিলেন দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। তবে সেসব এখন অতীত। এসব ঘটনা ভুলে সোমবার দিল্লিতে একটি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে গিয়েছিলেন মুইজ্জু। উদ্দেশ্য ছিল, তার সরকারকে চরম আর্থিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলারেও বেশি ভারতীয় সহায়তা নিশ্চিত করা। তাজমহলে স্ত্রীর সঙ্গে একটি ছবিও তোলার সুযোগ হয়েছিল তার।

মোদির পাশে দাঁড়িয়ে মুইজ্জু বলেছিলেন, ‘ভারত মালদ্বীপের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং আমাদের প্রয়োজনে সবসময় মালদ্বীপের পাশে দাঁড়িয়েছে।’

বিশ্বব্যাংকের মতে, চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী যখন করোনা মহামারির আগের সময়ের অর্থনীতির স্তরে ফিরে যাওয়ার জন্য লড়াই করছে, ভারতের অর্থনীতি তখন প্রায় ৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমলাতন্ত্রের হতাশা সত্ত্বেও ভারতকে বাণিজ্য ও চুক্তির জন্য একটি আকর্ষণীয় অংশীদার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতারা।

তবে অনেক দরিদ্র ভারতীয়রাই এই প্রবৃদ্ধি থেকে সুবিধা পাওয়ার তেমন কোনও আশা দেখছেন না। কেননা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে দেশটি এখনও হিমশিম খাচ্ছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি সরকারকে কূটনীতির চাকা চালানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ সরবরাহ করছে, যেখানে অর্থনৈতিক সংকট চীনকে তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে অর্থ সহায়তা প্রদানে কিছুটা লাগাম টানতে বাধ্য করেছে।

এই অঞ্চলে বারবার কূটনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও নতুন এই সক্ষমতা ও সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। চীনের আগ্রাসী চাপের মুখে এই অঞ্চলে ঐতিহ্যগত প্রভাব হ্রাস পেয়েছে দেশটির। গত এক বছরে অন্তত তিনটি দেশে ভারতপ্রীতি রয়েছে এমন নেতাদের হয় ভোটে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে, না হয় বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।

একসময়ের ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিরুপমা মেনন রাও বলেছেন, ‘ভারত এখন প্রতিবেশী অঞ্চলে অনেক বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে যে রাজনৈতিক স্বার্থ আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জুড়ে রাখে, আমি মনে করি সেক্ষেত্রে তারা বিশ্বস্ত।’

নিরুপমা বলেছিলেন, এমনকি এই অঞ্চলের নেতারা যারা ‘ঐতিহ্যগতভাবে ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বা গোঁড়া’ তাদের কাছেও দিল্লির সঙ্গে কাজ করা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। এটি শুধু তাৎক্ষণিকভাবে আর্থিক সাহায্য লাভের জন্যই নয় বরং, দীর্ঘমেয়াদে ভারতের সঙ্গে নিজেদের এক সারিতে রাখার জন্য জরুরি। কেননা, তাদের ভয়, ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ভবিষ্যতে তাদের বিপর্যয়কর অবস্থা ফেলতে পারে।

নিরুপমা আরও বলেন, আঞ্চলিক নেতারা ‘ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব ও বিশ্বমঞ্চে ভারত যে অবস্থানে যাচ্ছে তা বোঝার ওপর বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন।’ এদিকে, ভারত কিছু প্রতিবেশীর প্রতি ‘তোষামোদি’ ও ‘কূটনৈতিক চাল’ এড়িয়ে আগের চেয়ে আরও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে।

১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ২ হাজার মাইল সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর একটি কঠিন শিক্ষা পেয়েছে ভারত।

ভারতকে আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া রক্ষক হিসেবে দেখা হতো। শেখ হাসিনা যখনই তার সমালোচক ও বিরোধীদের নিপীড়ন করতেন, ভারত তখন তার পশ্চিমা সমালোচকদের চুপ করাতে নিজের কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ওপর জনতার ক্ষোভ ভারতের ওপর ক্ষোভে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল।

আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। সেখানে তার দীর্ঘ উপস্থিতি জনমনে একটি দ্বিধা তৈরি করেছে। একদিকে ভারত তার বন্ধুদের পাশে থাকার ইঙ্গিত দিতে চাইছে। তবে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া দেশটির জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে। কেননা, বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে দেশটি।

মূলত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর পল স্ট্যানিল্যান্ড তার গবেষণায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারতের আস্থা ফিরে পাওয়াকে অতীতের তুলনায় আরও ‘কঠিন’ চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এর জন্য অবশ্য ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

স্ট্যানিল্যান্ডের ভাষায়, ‘ভারতের প্রতিবেশীদের অবশ্যই ভারতের স্বায়ত্তশাসনে কোনও আপত্তি নেই এবং তাদের চীন ও বাইরের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মতো বিকল্প রয়েছে। তবে ভারত এমন একটি বিশাল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দেশ, যেটির সঙ্গে সব সরকারকে অন্তত ব্যবসাটা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের কিছু আঞ্চলিক সম্পর্ক এখন ‘দিল্লির সঙ্গে একটি সংযত ও সম্মানজনক অবস্থায়’ রয়েছে। তার এই মন্তব্য যেন নিরুপমার উল্লেখিত একটি বিষয়েরই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছিলেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে কাজ করার উদ্দীপনা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেতিবাচক জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াও সীমিত করে।’

এরকম সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের বর্তমান সম্পর্ক।

শ্রীলঙ্কায় ২০০৯ সালের গৃহযুদ্ধের পর দেশটিতে চীনের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। তখন একজন জনতোষণবাদী প্রেসিডেন্টের বিলাসবহুল সব উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করেছিল চীন। কলম্বোর কর্মকর্তারা, এমনকি ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও তখন অভিযোগ করেছিলেন যে শ্রীলঙ্কায় দিল্লির উপস্থিতি তখন তুলনামূলক ধীর ও আমলাতান্ত্রিক ছিল।

দুই বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মূলত অব্যবস্থাপনা ও লাগামহীন ব্যয়ের কারণে এই সংকট দেখা দিয়েছিল। এতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চীন কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার ঋণের শর্তাদি পুনরায় আলোচনা করতেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল চীন। আর ভারত তখন এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সহায়তায় ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে হাজির হয়।

ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির এমন পরিবর্তন রাজনৈতিক ফ্রন্টে আরও বেশি দৃশ্যমান ছিল। একবার যখন এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতনের কারণে ভারতের ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদসহ দেশটির পুরনো মিত্রদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, মোদি সরকার তখন অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা চালায়।

সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ভারত একটি ছোট বামপন্থি দলের নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকেকে অভ্যর্থনা জানায়। দলটি অতীতে ভারতবিরোধী ছিল। জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত তাকেই মনে হয়েছিল। উভয়পক্ষ অতীত পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে আগ্রহী ছিল বলে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। গত মাসে দিসানায়েকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর কলম্বোতে তাকে অভিনন্দন জানাতে দেরি করেনি ভারত। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ছুটে যান ভারতের শীর্ষ কূটনীতিক।

নিরুপমা বলেছিলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ও সেখানে দেশটির ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংস্থানগুলো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশটিকে ভালোভাবেই এগিয়ে রাখবে।

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক বিষয়ে চীন অনেক ভেবেচিন্তে ব্যয় করছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমি মনে করি, আমাদের প্রতিবেশীরা সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাগুলোতে চীন প্রথম সহযোগী হিসেবে পাশে দাঁড়ায়নি, যেটি করেছে ভারত। আর এটিকে আমি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করি।’